timesofbangladesh.com
প্রকাশ : ১৫:৫৯, ১৬ মার্চ ২০২৪

রমজানে পীরবাড়ির মেজবানি

শারমিন রিমা, সিভয়েস২৪
রমজানে পীরবাড়ির মেজবানি

রাতভর ধুপ ধাপ মাংস কাটার শব্দ, হামান দিস্তার টুং টাং আর মশলাপাতি গুড়ো করার আয়োজন। দিনের আলো ফুটতেই পেঁয়াজ কাটাকুটির পাশাপাশি শিল পাটায় চলে নানা রকম মশলা পিষার শব্দ। সবশেষে হাঁড়িতে রান্না চড়াতেই সরিষা তেলের সাথে মশলা আর মাংসের সুঘ্রাণ ভাসতে থাকে বাতাসে। রান্না শেষে হাঁড়ির ঢাকনা সরাতেই চারদিকে মৌ মৌ করছে মেজবানি মাংসের সুঘ্রাণ। 

এ আয়োজন শুধু এক দুদিনের জন্য নয়, পুরো রমজানজুড়ে চলে। দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে চট্টগ্রাম নগরের চৌমুহনী এলাকার পীরবাড়ির সদস্যদের রান্না করা মেজবানি মাংস আর চনার ডালের সুখ্যাতি রয়েছে। পারিবারিক ‘ঐতিহ্য’ হিসেবে পীরবাড়ির মেজবানির মাংসের এই আয়োজন হয় কেবল রমজান মাসে। 

জানা গেছে, রমজান মাসে গরুর মাংস কেটে বিক্রি করতেন পীরবাড়ির সদস্যরা। নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে পীরবাড়ির সদস্য ইলিয়াস, ইদ্রিস, আজিজ ও কুতুব উদ্দিন গরুর মাংস কেটে বিক্রির জন্য দুটি গরু কেনেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রায় ২০ কেজি মাংস অবিক্রিত রয়ে যায়। পরবর্তীতে পরিবারের বয়োজেষ্ঠ্যদের পরামর্শে শুরু হয় মেজবানি মাংস রান্না করে বিক্রির রেওয়াজ। সেই থেকে এখনো প্রতি রমজানেই চলে মেজবানি মাংসের এই আয়োজন। 

প্রতিকেজি মেজবানি মাংস ৯০০ টাকা আর চনার ডাল ২৫০ টাকা করে রমজানের শুরুর দিকে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ কেজি মেজবানি মাংস বিক্রি হয়। তবে ১০ রমজানের পর প্রতিদিন ২ মণের মতো মাংস বিক্রি হয় বলে জানান পীরবাড়ির সদস্যরা। শুরুর দিকে এই মেজবানি মাংস রান্না করেছিলেন বাবুর্চি খালেক। তিনি অসুস্থ থাকায় সেই দায়িত্ব এসেছে সিরাজ বাবুর্চির হাতে। 

সরেজমিন দেখা যায়, পীর বাড়ির সামনে তাঁবু টাঙিয়ে বসানো হয়েছে অস্থায়ী দোকান। সবে মাত্র শেষ হয়েছে রান্না। জলন্ত কয়লার লাল শিখা এখনো চোখে পড়ছে। তার পাশেই টেবিলে রাখা আছে নানা আকারের প্লাস্টিকের বাটি আর বাকরখানি রুটি। সকাল থেকে শুরু হয় পীরবাড়ির এই মেজবানের আয়োজনের কর্মযজ্ঞ। সিরাজ বাবুর্চির রান্নার জাদুতে একপাশে চলে রান্নার আয়োজন আর অন্যপাশে চলে বেচাবিক্রির ধুম। মূলত বিকেল ৩টার পর থেকে ক্রেতারা পীরবাড়ির মেজবানি মাংস কিনতে ভিড় জমাতে শুরু করে।

দোকানেই কথা হয় পীর বাড়ি পরিবারের সদস্য মো. নাদিম ইউসুফের সঙ্গে। তিনি সিভয়েস২৪-কে বলেন, ‘শুরুতে আমার বড় ভাই ও চাচা মিলেই এই উদ্যোগ নেয়। তারপর থেকে বংশপরম্পরায় মেজবানের মাংস বিক্রির আয়োজন চলে আসছে। ছোটবেলা থেকেই আমি যুক্ত আছি। সারাবছর তো সবাইকে একত্রে পাওয়া যায় না। প্রত্যেক রমজানে এই মেজবানের মাংসের আয়োজন করা হয়। তখন এটা একটা মিলনমেলার মতো হয়ে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘শুরুর দিকে একটু কম বেচাবিক্রি হয়। কিন্তু কয়েক রমজানের পর থেকেই প্রতিদিন প্রায় দেড় মণ থেকে ২ মণ মাংস বিক্রি হয়। প্রথম রমজানে ২০ থেকে ২৫ কেজি বিক্রি হয়েছে। যদিও মাগরিবের পরপরই বিক্রি শেষ হয়ে যায়। আমাদের দেখাদেখি এখন এই এরিয়াতেই ১৫টা দোকান বসেছে। কিন্তু আমাদের পীরবাড়ির মেজবানের মাংস ঐতিহ্যবাহী বলে সবাই এখানে ছুটে আসে।’ 

দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে দুবাইতেও যায় পীর বাড়ির রান্না করা মেজবানের মাংস। মেজবানের মাংসের চাহিদা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামের মানুষ ছাড়াও ঢাকাতে আমাদের মেজবানের মাংসের চাহিদা অনেক। এর বাইরে দুবাইতেও আমাদের মেজবানের মাংস যায়। যেহেতু বিমানে আড়াই তিন ঘণ্টা লাগে তাই ফ্রিজিং করে পাঠানো হয় দুবাইতে।’

প্রসঙ্গত, ‘চাটগাঁইয়া মেজ্জাইন্যা খানা খাইলে বুঝিবা; ন খাইলে পস্তাইবা’— লোকমুখে বহুল প্রচলিত কথাটি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। একসময় প্রয়াত আত্মীয়স্বজনদের আত্মার শান্তিকামনায় মেজবানের আয়োজন করা হলেও ধীরে ধীরে ইফতারির আয়োজনেও জায়গা করে নিয়েছে এই মেজবান সংস্কৃতি।

জনপ্রিয় সংবাদ