timesofbangladesh.com
প্রকাশ : ১৪:১১, ১৪ মার্চ ২০২৪

দস্যুরা ভিলেন না ভিকটিম?
ভারত সাগরে সোমালি জলদস্যুর উত্থান যেভাবে

বিশেষ প্রতিবেদক, সিভয়েস২৪
ভারত সাগরে সোমালি জলদস্যুর উত্থান যেভাবে

বাংলাদেশের তুলনায় সাড়ে ৪ গুণ বড় আকারের সোমালিয়া নামের দেশটি অবস্থিত আফ্রিকার উত্তর-পূর্ব কোণে।  ৩ হাজার ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ  সমুদ্র উপকূল রয়েছে দেশটিতে। অথচ গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুধার্ত দেশ হিসাবে স্বীকৃত ও পরিচিত সোমালিয়া। প্রায় ৩০ বছর  ধরে সেখানে চলছে গৃহযুদ্ধ।  দরিদ্র এ দেশটিতে  মানবিক সংকটও প্রকট।

সহিংসতা এবং অস্থিতিশীলতার দীর্ঘ ইতিহাস দেশটির। দেশটির উত্তর-পশ্চিমে সোমালিল্যান্ড, উত্তর-পূর্বে পুন্টল্যান্ড এবং মধ্য ও দক্ষিণ অঞ্চলে মধ্য সোমালিয়া। দেশটিতে ফেডারেল সরকার থাকলেও প্রকৃতপক্ষে সোমালিয়া তিনটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে কিছু গোষ্ঠীর তৈরি করা পদ্ধতিতে শাসিত হয়।  প্রবল দারিদ্র্য ও বেকারত্বে ভোগা দেশটির ৪০ শতাংশেরও বেশি চরম দারিদ্র (দিনে ১০০ টাকার কম আয়) এবং প্রায় ৭৫  শতাংশ পরিবার প্রতিদিন ২০০ টাকারও কম আয় করে। আনুমানিক দুই-তৃতীয়াংশ সোমালিয় যুবক কর্মহীন। নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, দুর্নীতি, অস্ত্রের বিস্তার, চরমপন্থার কারণে সোমালিয়ার বেশিরভাগ অংশে, বিশেষ করে পুন্টল্যান্ড এবং মধ্য সোমালিয়ায় অপরাধকে সহজ করে। এ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডই শেষ পর্যন্ত স্থল থেকে সমুদ্রে এসেছে।

জলদস্যু কারা?

সোমালি জলদস্যুরা সাধারণত অল্পবয়সী হয়। কিশোর থেকে ৩০ বছর বয়সের যুবা যারা অল্প শিক্ষিত, বেকার এবং অসন্তুষ্ট পুরুষদের মধ্য থেকে তাদের বেছে নেওয়া হয়। একে ৪৭ ও রকেট চালিত গ্রেনেড ও বন্দুক তাদের প্রধান অস্ত্র।

জলদস্যুরা সাধারণত চার থেকে ছয় জনের দলে কাজ করে এবং মুষ্টিমেয় কিছু ‘জলদস্যু কর্তা’ রয়েছে যারা দস্যুদের সংগঠিত করে ও নৌকা, অস্ত্র এবং সরবরাহ করে। কর্তাদের যারা অর্থদাতা, তারা কিন্তু সরাসরি জলদস্যুতায় জড়িত হয় না। তারা জলদস্যুতায় বিনিয়োগ করে। দস্যুতা ও মুক্তিপণ নিয়েই তাদের অবৈধ ব্যবসা।

ইন্টারন্যাশনাল এক্সপার্ট গ্রুপ অন পাইরেসি অফ দ্য সোমালি কোস্টের নভেম্বর ২০০৮-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুসারে উল্লেখ্য কিছু জলদস্যু দল হল ইয়েল,গারদ ওমর, হবিও হাবরগেদির, হরধীর হাবরগেদির।

সোমালি জলদস্যুতা বেপরোয়া ও নির্লজ্জ, কিন্তু তারা প্রযুক্তির দিকে পিছিয়ে। জলদস্যুরা ছোট স্কিফ ব্যবহার করে যা ৩০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত যেতে পারে। এছাড়াও ছোট নৌকাগুলোতে থাকে ৩-৫জন। তারা ঝাঁকে ঝাঁকে এসে লক্ষ্যবস্তু জাহাজকে ঘিরে ধরে পরে হুক এবং মই দিয়ে জাহাজে উঠে পড়ে। ওরা সাধারণত ওইসব জাহাজকেই হাইজ্যাক করে, যেগুলোর পাশ নিচু ও সাধারণত ধীরগতির জাহাজ।

কারা জলদস্যুদের অর্থদাতা?

জলদস্যুদের অর্থায়ন করে সোমালিয়ার প্রভাবশালীরা যারা গৃহযুদ্ধে জড়িত, তারা নিজ নিজ ক্ষমতার অঞ্চলে প্রভাব বজায় রাখে। তাদের অর্থায়নে জলদস্যুরা জাহাজ ছিনতাই করে পরে জাহাজ নাবিকদের মুক্তিপণের টাকায় ভাগ দিতে হয় এসব অর্থদাতাদের। সোমালিয়ার উপকূলীয় শহরগুলোর অর্থায়নই হয় জলদস্যুতা থেকে তাই তাদের জলদস্যুতাবিরোধী অভিযানে অংশ নেওয়ার কোন কারণ নেই। তবে সেখানে সোমালিয়া সরকারের তত্ত্বাবধান নেই বললেই চলে।

এ পর্যন্ত কত মৃত্যু কত বন্দি?

অনলাইন ডাটা ওয়েব স্ট্যাটিস্টা ২০১৫ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সোমালি জলদস্যুদের বন্দির সংখ্যা, নির্যাতনের ভুক্তভোগীর সংখ্যা ও তাদের হাতে নিহত হওয়া নাবিকদের সংখ্যার পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে।

সেখানে সর্বশেষ ২০২২ সালে ৪৩ জনকে বন্দি করা হলেও হত্যা করা হয়নি কাউকেই। ২০২১ সালে ৬৫ জনকে বন্দি ও ৪ জনকে নির্যাতন ও ১জনকে হত্যা করা হয়েছে। ২০২০ সালে ১৬৯জনকে বন্দি ও ৬ জনকে নির্যাতন করা হলেও কাউকে হত্যা করা হয়নি। এর আগে ২০১৯ সালে ১৯৩ জনকে বন্দি করে তাদের মধ্যে একজনকে হত্যা করা হয়। ২০১৮ সালে ২২৪ জনকে বন্দি করা হলেও কাউকে হত্যা করা হয়নি।  

তবে আন্তর্জাতিক মেরিটাইম ব্যুরোর রিপোর্ট বলছে, ২০১১ সালে অন্তত ৩৫জন জিম্মিকে হত্যা করেছে সোমালি জলদস্যুরা। প্রতিবছর তাদের কাছে বন্দির সংখ্যা ৫ শতাধিক। সাধারণত জলদস্যুরা সহিংস আক্রমণ করলেও শুরুতেই হত্যা করে না। পালানোর চেষ্টা বা মুক্তিপণ না দিলে তারা হত্যা করে।

আন্তর্জাতিক প্রকল্প ব্যবস্থাপক কাইজা হারলবার্ট ২০১১ সালে রয়টার্সকে বলেছিলেন, ‘আমরা সবাই জানি মৃত্যুর এ পরিসংখ্যানে ঘাপলা আছে। অনেক জাহাজ নেওয়া হচ্ছে যা রিপোর্টই করা হয় না। প্রত্যেকবারে ১২ থেকে ২০ জন লোক থাকতে পারে।’

যে দেশে কোন আইন নেই?

সোমালি কর্মকর্তাদের ডাটা বলছে—জলদস্যুদের অর্থলাভ পুরোটাই করমুক্ত। তবে সোমালিয়ার জলদস্যু পেশা কোন অর্থনীতি ব্যবস্থার গল্প নয়। এটি একটি  বিশৃঙ্খল দেশ যেখানে অগণিত শিশু অনাহারে থাকে। যেখানে এক মুঠো শস্যের জন্য এক মানুষ অবলীলায় হত্যা করে অন্য মানুষকে। তাই নিশ্চিত করে বলা যায় না ওরা ভিলেন না ভিকটিম।

জলদস্যুদের প্রশ্রয় কী?

জাতিসংঘের সমুদ্র সংক্রান্ত আইন ‘দ্যা ইউএন কনভেনশন অন দ্যা ল অফ দ্য সি (ইউএনসিএলওএস) এর সংজ্ঞায়:

 ‘জলদস্যুতা’ নিম্নলিখিত কাজগুলির মধ্যে যে কোনো একটি নিয়ে গঠিত:

 (ক) কোনো বেআইনি সহিংসতা বা আটক, বা অবজ্ঞার কোনো কাজ, ক্রু বা ব্যক্তিগত জাহাজ বা ব্যক্তিগত বিমানের যাত্রীদের দ্বারা ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে সংঘটিত এবং নির্দেশিত: উচ্চ সমুদ্রে, অন্য জাহাজ বা বিমানের বিরুদ্ধে, বা এই ধরনের জাহাজ বা বিমানে থাকা ব্যক্তি বা সম্পত্তির বিরুদ্ধে; কোনো রাষ্ট্রের এখতিয়ারের বাইরে কোনো জাহাজ, বিমান, ব্যক্তি বা সম্পত্তির বিরুদ্ধে;

(খ) একটি জাহাজ বা বিমানের পরিচালনায় স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণের যে কোন কাজ যা তথ্যের জ্ঞান সহ এটিকে জলদস্যু জাহাজ বা বিমানে পরিণত করে;

(গ) উপ-অনুচ্ছেদ (ক) বা (খ) তে বর্ণিত কোনও কাজকে উসকানি দেওয়া বা ইচ্ছাকৃতভাবে সুবিধা দেওয়ার কোনও কাজ

ইউএনসিএলওএস-এর অধীনে প্রদত্ত সংজ্ঞাটি প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন যা জলদস্যুতার অপরাধের খুবই ক্ষুদ্র ব্যাখ্যা দেয়।

প্রথমত, গভীর সমুদ্রে জলদস্যুতা ঘটতে হবে। সোমালি জলদস্যুরা যদি সোমালিয়ার আঞ্চলিক জলসীমায় একটি জাহাজ হাইজ্যাক করে, তবে আক্রমণটি ইউএনসিএলওএস-এর অধীনে জলদস্যুতা হিসাবে গণ্য হবে না। তাই, যদিও টহলরত দেশগুলিকে জলদস্যুদের আক্রমণ ঠেকানোর জন্য সোমালিয়ার আঞ্চলিক জলসীমায় প্রবেশের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে, যদি সেই জলসীমায় আক্রমণ ঘটে, তবে আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে সেগুলিকে জলদস্যুতার আক্রমণ হিসাবে বিবেচনা করা হবে না।

দ্বিতীয়ত, জলদস্যুদের আক্রমণে অবশ্যই দুটি জাহাজ অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে: একটি শিকার এবং একটি আক্রমণকারীর জাহাজ। যেখানে জলদস্যুরা শেষ বন্দরে শিকারের জাহাজে চড়ার চেষ্টা করে এবং তারপরে, গভীর সমুদ্রে গিয়ে হাইজ্যাক করে। এই ক্ষেত্রে, যদিও হাইজ্যাকিং প্রায় জলদস্যুতার অনুরূপ, তবে এটি জলদস্যুতা হিসাবে বিবেচিত হবে না।

তৃতীয়ত, এ আইন অনুসারে জলদস্যুতা হতে হলে সেটিকে ‘ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে’ জলদস্যুতার কাজ হতে হবে। জলদস্যুরা যদি কোনো রাজনৈতিক কারণে বা তারা কোনো রাষ্ট্রীয় সংস্থার হয়ে কাজ করে তাহলে আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে তাদের কাজগুলো জলদস্যুতা হিসেবে গণ্যই হবে না।

আইনের বিদ্যমান ফাঁকফোকর ছাড়াও, প্রধান সমস্যা হল এসব আইনের  প্রয়োগযোগ্যতা। ইউএনসিএলওএস কনভেনশন কেবল ফাঁকা আইনি ভাষায় সীমাবদ্ধ। আইনের বাস্তবায়ন নির্ভর করে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ওপর। অন্য কথায়, এ আইনের কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা নেই।

কেনিয়া, সেশেলস এবং মরিশাসের মত বেশ কিছু দেশ প্রতিবেশী দেশের সাথে চুক্তি করেছে এবং দেশগুলোর আদালতে জলদস্যুদের ধরার এবং বিচার করার চেষ্টা করেছে। জাতিসংঘ একটি জলদস্যু যোগাযোগ দল প্রতিষ্ঠা করেছে, এটি রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের দলের মাধ্যমে বছরে কয়েকবার মিলিত হবে এবং সোমালিয়ায় জলদস্যুতা সংকটের সমাধান খুঁজতে কাজ করবে।

আপাতত সবচেয়ে সহজ সমাধান হবে ভারত মহাসাগরে টহল বৃদ্ধি করা এবং জলদস্যুদের ধরে আঞ্চলিক অংশীদারদের আদালতে তাদের বিচার করা এবং বেলাশেষে, মেরিটাইম নেশনসকে নিশ্চিত করতে হবে যে এই জলদস্যুরা যেন আধুনিক যুগের অমানবিক জাতিতে পরিণত না হয়।

জনপ্রিয় সংবাদ